চিল্কীগড় রাজবাড়ি ও কনক দূর্গা মন্দির
ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনী ব্লকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো চিল্কিগড় রাজবাড়ী। ঝাড়গ্রাম থেকে ১৫ কিমি দূরত্বে ডুলুং নদী পেরিয়ে চিল্কিগড় রাজবাড়ীতে পৌঁছে যাওয়া যায়।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই রাজবাড়ী তে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। বাইরে থেকেই রাজবাড়ীর সামনে বিস্তৃত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে রাজবাড়ী দর্শন করে ফিরে আসতে হত। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে রাজবাড়ীর সিংহদুয়ার। অবশ্য শুধুমাত্র যারা রাত্রিযাপন এর ইচ্ছে প্রকাশ করবেন তাদের জন্য।
প্রায় ৩০০ বছর আগে জামবনীর রাজা ছিলেন সামন্ত রাজা ভূমিপুত্র গোপীনাথ সিংহ। এবং চিল্কিগড় ছিল তার রাজধানী। গোপীনাথ সিংহের আমলেই এই রাজবাড়ীটি তৈরী হয়েছিল। পুত্রহীন রাজার একমাত্র কন্যা সুবর্ণমনির সাথে পরবর্তী কালে বিবাহ হয় পার্শ্ববর্তী ধলভূমগড়ের রাজা জগন্নাথ সিংহ দেও ধবলদেব এর সাথে। ১৭৬৫ সালে রাজা গোপীনাথ সিংহের মৃত্যুর পর চিল্কিগড়ের রাজা হন জগন্নাথ সিংহ। ওনাদের পুত্র কমলাকান্ত দেও ধবলদেবের সময়কে চিল্কিগড়ের স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়।
বড় রাস্তার উপরেই রাজবাড়ীর প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলেই একটি বিশাল প্রাঙ্গন। মুঘল এবং ব্রিটিশদের মিলিত স্থাপত্যশৈলিতে তৈরি দ্বিতল এই রাজবাড়ির দেওয়ালে অন্যান্য কারুকার্যের সাথে বাংলার রীতি কল্পার কাজও চোখে পড়ে।
মেন প্রবেশদ্বারে ঢুকেই বাঁদিকে একটি শিব মন্দির। চত্বরের মধ্যে আরো দুটি মন্দির চোখে পড়ে। একটি রাধাকৃষ্ণের মন্দির আরেকটি সম্ভবত জগন্নাথ দেবের মন্দির বলে অনুমান করা হয়। কারণ মন্দির প্রাঙ্গনেই একটি রথের কাঠামো দৃশ্যমান।
বাঁদিকে মন্দির গুলিকে রেখে একটু এগোলেই আরেকটি গেট। সেই গেট পেরোলে আরো একটি রাজবাড়ী। তার পাশেই নানা ছোট বড় ফুলের বাগান। আর তার পাশেই অতিথিশালা। এখানেই কয়েকটি ঘরকে পুরোনো ঐতিহ্যকে মুছে না দিয়ে আসবাবগুলোকে কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফাঁকা রাজবাড়ীতে গা ছম চম পরিবেশে রাত্রিযাপন পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। ঘরের সাথেই নতুন করে এটাচ বাথরুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেগুলোতে ইন্ডিয়ান এবং ওয়েস্টার্ন দুরকমই ব্যবস্থা আছে।
খুব অল্প খরচেই রাজবাড়ীতে রাত্রিযাপন করা যায়। ৮০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকার মধ্যেই এই ব্যবস্থা। তবে খাওয়া খরচ আলাদা। বাইরের স্থানীয় এক পরিবার অর্ডার মতো খাবার সাপ্লাই দিয়ে যায়। ভেতরে খাবারের আয়োজন এখনো করতে পারেনি বলে জানালেন রাজপরিবারের এক সদস্যা। তবে খুব শীঘ্রই আরো কয়েকটি ঘর খুলে দেওয়া হবে এবং ক্যান্টনও চালু করা হবে বলে জানালেন পরিবারের সদস্যা পল্লবী সিং ধবল।

রাজবাড়ীর অনতিদূরেই অবস্থিত কনক দূর্গা মন্দির। ডুলুং নদী পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় মন্দিরে।
রাজা গোপীনাথ সিংহ প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো।
অশ্বারোহিনী চতুর্ভুজা সোনার তৈরি দেবীর মুর্তি ছিল বলেই মন্দিরের নাম কনক দূর্গা মন্দির। ১৯৬০ সালে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আসল মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। বছর ছয়েক পরে গোপীনাথের বংশধরেরা অষ্টধাতুর একটি কনক দূর্গার মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের পাশেই আছে বিশাল এলাকা জুড়ে একটি ভেষজ গাছ গাছালির উদ্যান। প্রায় ৩০০ র ও বেশি প্রজাতির গাছ এখানে বর্তমান। মন্দির চত্বরে বানরের উপদ্রব একটু বেশি। স্থানীয় লোকমুখে শোনা কনক দূর্গা অত্যন্ত জাগ্রত দেবী। একসময় এখানে নরবলি দেওয়া হত। পরবর্তী কালে মহিষ এবং ছাগ বলি দেওয়া হয়। দুর্গাপূজার চারদিন বিশেষ রীতি আচার মেনে বেশ জাকজমক ভাবে পুজা হয় দেবীর। এই চারদিনে দেবীকে হাসের ডিম, মাছ পোড়া, শাক ভাজা, পান্তা ভাতের ভোগ নিবেদন করা হয়। অষ্টমীর রাতে মন্দিরে পাতকুয়োর সামনে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। নবমীর অন্ন ভোগের আগে বলির মাংস নতুন মাটির হাঁড়িতে সেদ্ধ করে রাখা হয়। মহাষ্টমী তে হাঁসের ডিমের ভোগও দেওয়া হয়। নতুন মাটির হাঁড়িতে জল ও অন্যান্য সামগ্রী ভরে শালপাতা দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে উনুনে চাপিয়ে দেওয়া হয়। উনুনে তিনটি কাঠে আগুন জ্বেলে তালা চাবি দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস দেবী স্বয়ং এসে এই ভোগ রান্না করে।