![]() |
প্রতীকি ছবি |
ইলা মুৎসুদ্দী আজ ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। ‘কন্যা মানেই বোঝা নয়, করবে তারা বিশ্ব জয়’। কন্যা শিশুর যথাযথ শিক্ষা, পুষ্টি,
নিরাপত্তা
নিশ্চিতকরণ তথা সুষ্ঠু বিকাশকে সামনে রেখেই “জাতীয় কন্যাশিশু
দিবস’’ পালন শুরু হয়। ইভটিজিং, এসিড সহিংসতা এবং যৌন নির্যাতনসহ কন্যা শিশুর প্রতি সকল
প্রকার সহিংসতা বন্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাই ছিল লক্ষ্য। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার
৪৫ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু এবং এদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই কন্যাশিশু। শিশুদের অধিকার
প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হলেও আজও দেশের অধিকাংশ কন্যাশিশুর
বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগেই। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে-২০০৭ এর তথ্য
অনুযায়ী দেশে এখনও ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এবং দুই দশক ধরে এ
হারের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আর ১৯ বছরের আগেই গর্ভবতী হচ্ছে ৬৬ শতাংশের এক
শতাংশ। বাংলাদেশে নারীর গড় বিয়ের বয়স ১৫ বছর ৩ মাস। ইউনিসেফের তথ্যমতে, শিশু বিবাহের হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় । গত ৩০ বছরে শিশুবিবাহ আনুপাতিক হারে হ্রাস পেলেও
গ্রামাঞ্চলে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমস্যাটা প্রকট। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য
এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। বেশীরভাগ পরিবারে কন্যাশিশুদের অবহেলার চোখে দেখা হয়।
দেখা যায় সমবয়সী ভাই-বোন একসাথে খেতে বসেছে,
মাছের
কিংবা মাংসের ভালো টুকরাটা দেয়া হচ্ছে ছেলে সন্তানের পাতে। অন্যদিকে মেয়ে বলে তাকে
ছোট টুকরাটিই দেয়া হয়। এখানে কন্যাশিশুটি পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। কারণ ছেলে
সন্তানকে পরিপূর্ণ পুষ্টিকর খাবার দিতে পরিবার যেভাবে ব্যতিব্যস্ত, কন্যাশিশুটির বেলায় সেরকম নয়। অনেক পরিবারে
কন্যাশিশুর পর্যাপ্ত পুষ্টিচাহিদা পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয় না। কিন্তু শিশুর মেধার
বিকাশ ছোটবেলাতেই হয়। আর এ বয়সে তার মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন চলাফেরার সুযোগ থাকা
প্রয়োজন। তার অনুভূতিগুলো প্রকাশের সুযোগ থাকা দরকার। ঘরের কোন কিছু ভেঙ্গে গেছে, সেই দায় এসে পড়ে কন্যা সন্তানের উপর , ধমক বলুন আর বেত্রাঘাত বলুন সব মেয়েটির জন্যই
প্রাপ্য হয়। বাইরের আত্মীয়-স্বজন আসলে প্রথমেই খবর নেয় ছেলে সন্তানটির। মেয়েটি
কেমন আছে কেউ জানতে চায় না। মেয়েটির ইচ্ছে হলো ভাইয়ের মতো সেও সাইকেল চালনা শিখবে, পরিবার থেকে বাধা এল, তুমি মেয়ে মানুষ-- সাইকেল শিখে তুমি কি করবে? ভাই যদি একা একা ষ্কুলে যেতে পারে তাহলে
মেয়েটি পারবে না কেন? কেন মেয়েটিবে
পাহারা দিয়ে আনতে হবে, নিতে হবে।
বান্ধবীর জন্মদিনে যেতে চায় মেয়েটি,
আবারো
অভিভাবকরা নিষেধাজ্ঞা জারি করে, মেয়েদের সব জায়গায়
যেতে নেই। এই যে সবসময় সবকিছুতে না উচ্চারণ এসব শুনতে শুনতে কিশোরী মেয়েদের মনে এর
একটি প্রভাব পড়ে। সে নিজেকে অন্যদের চাইতে আলাদা জগতের একজন ভাবতে শুরু করে।
ছোটকাল থেকেই সে জেনে যায় তার আপনজনেরা তার সাথে সবসময় বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। আবার
অনেক পরিবার আছে যারা মেয়েদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজে অংশগ্রহণ
করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ধর্মের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজ থেকে
তাদের দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। এভাবে সবসময় না বোধক শব্দটি কন্যাশিশুর মনে
বিরূপ প্রভাব ফেলে। আজকের কন্যাশিশু আগামী
দিনের নারী তথা মা। তাই প্রতিটি কন্যাশিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে তাদের অধিকার
প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সকলের কর্তব্য। বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়নে
অত্যন্ত আন্তরিক। এ লক্ষ্যে সরকার কন্যাশিশুদের উন্নয়নে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ পরিপূর্ণ বিকাশে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের এসব পদক্ষেপ বহির্বিশ্বেও প্রশংসিত হচ্ছে। তবে কন্যাশিশুদের সামগ্রিক
উন্নয়নে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। বিশেষ করে পরিবারের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অত্যধিক
। পরিবার থেকে কন্যাশিশু ও ছেলেশিশুকে বিভেদ না করে তাদের সমান যত্ন, খাবার,
পুষ্টি, বিনোদন ও লেখাপড়ার সুযোগসহ অন্যান্য অধিকার
নিশ্চিত করলে কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্য দূর হবে। গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। একটি
জাতির উন্নয়নে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিটি কন্যাশিশু
যাতে যত্নের সাথে বেড়ে উঠতে পারে এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সে লক্ষ্যে সকলকে
সচেতন হতে হবে। পরিবারে একটি কন্যাশিশু ও
তার সমবয়সী একটি ছেলেসন্তানের মতো আদর-যত্ন দিয়ে লালন পালনের প্রতি সব মা-বাবাকেই সচেতন ও সচেষ্ট থাকতে
হবে। তা না হলে এর প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। সরকারি বিভিন্ন ইতিবাচক
পদক্ষেপের ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় কন্যাশিশুর অগ্রগতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তারপরও নারী শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পারিবারিক কাজের দায়ভার, নিরাপত্তাহীনতা,
বাল্যবিয়ে
ইত্যাদি কারণে এখনো নারীরা মাধ্যমিক,
উচ্চ
মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে নারীর
জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে মানব সম্পদ বৃদ্ধির মাধ্যমে কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য ও
বঞ্চনা দূরীকরণের জন্য সরকার শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছে। সে
লক্ষ্যে সরকার বিগত বছরগুলোতে ছাত্রী ও নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার
জন্য নারীবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি। শিক্ষা
কন্যাশিশুর উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ
এবং শিশু মৃত্যুর হার কমানোর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কন্যাশিশু ও নারীকে অবজ্ঞা, বঞ্চনা ও বৈষম্যের মধ্যে রেখে কখনোই একটি
ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারে না। পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে তাদের জন্য সমসুযোগ ও সমঅংশগ্রহণ
নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে। আর এই মানবসম্পদ গড়ার
প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে কন্যাশিশুর জন্মলগ্ন থেকে। আজকের কন্যাশিশু আগামী দিনের
নারী এবং একজন মা। তাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত
করা সময়ের দাবি। লেখক :
কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক। বাংলাদেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার,
১০:১০ এএম